ঢাকা শুক্রবার | ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকার বনভূমি রক্ষায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথমবারের মতো গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া হয়েছে। শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা রান্নার কাঠ সংগ্রহ করতে উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমির ওপর নির্ভরশীল।
পরিবেশবাদীদের হিসেবে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ লাখ কেজি শুকনো কাঠ পোড়াচ্ছে, ভেজা অবস্থায় এর পরিমাণ কমপক্ষে আট লাখ কেজি।
তাঁদের মতে, বিকল্প জ্বালানি দেওয়া না হলে অচিরেই কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রোহিঙ্গা সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী বেনারকে বলেন, “কাঠের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আমরা গত মাস থেকে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে কুতুপালং ও অন্যান্য শিবিরে ১১ হাজার পরিবারকে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “প্রথম প্রকল্পের ফলাফল দেখে আমরা সম্ভব হলে এ মাস থেকেই আরও কয়েক হাজার পরিবারকে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া শুরু করব।”
হাবিবুল কবির বলেন, ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কেরোসিন ও স্টোভ সরবরাহ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
“তবে সমস্যা হচ্ছে, সেই কেরোসিন পাত্রে দেওয়া হবে না। ভারত সরকার জাহাজে করে খোলা অবস্থায় দিতে চায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশে এই খোলা কেরোসিন রাখার মতো ডিপো নেই। আর কেরোসিন বিতরণ একটি কঠিন কাজ,” বলেন হাবিবুল কবির।
তিনি জানান, ভারত থেকে পাঠানো ওই কেরোসিন আশেপাশে কোথাও রাখা সম্ভব কি না সে বিষয়ে মতামতের জন্য দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে শরণার্থী শিবিরে গ্যাস সরবরাহের খরচ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কারিতাস।
শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আইওএম এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহয়তায় রোহিঙ্গাদের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে।
কমিশনার কালাম বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কাঠের বিকল্প জ্বালনি না দেওয়া হলে উখিয়া, টেকনাফ ও আশেপাশের এলাকার গাছপালা রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
পরিবেশবাদীরা রোহিঙ্গাদের আগমনের পর থেকে উখিয়া, টেকনাফ ও পার্শবর্তী বান্দরবান জেলায় ব্যাপক বন উজাড়ের কথা বলে আসছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উখিয়া ও টেকনাফে ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
কয়েকসপ্তাহ আগে রোহিঙ্গা শিবিরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী ও শিশুরা দলে দলে আশেপাশের বন জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ঘাড়ে করে গাছ নিয়ে ফিরে আসছে।
ব্যাপক চাহিদার কারণে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ লাকড়ির ব্যবসা শুরু করেছে। উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে অসংখ্য লাকড়ির দোকান।
কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসকারি রোহিঙ্গা পুরুষ শাহ আলম বেনারকে বলেন, তাঁর সাত সদস্যের পরিবারের রান্নার কাজে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ কেজি লাকড়ির প্রয়োজন হয়। কিনতে গেলে কমপক্ষে প্রতিদিন দেড়শ টাকা প্রয়োজন।
তিনি জানান, প্রতিদিন সকালে আশেপাশের বনে গিয়ে গাছের ডাল কেটে আনেন। লাকড়ি জোগাড় করতে প্রতিদিন চার–পাঁচ ঘন্টা ব্যয় হয়। তিনি বলেন, চাল, ডাল তেল—সবই আমরা পাই। কিন্তু লাকড়ি ছাড়া তো আর রান্না চলে না।”
কুতুপালং ক্যাম্পের পাশের বন থেকে গাছ কেটে ফিরছিলেন রোহিঙ্গা মাহমুদুল ইসলাম। ডাল না কেটে পুরো গাছ কেন কেটেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বেনারকে বলেন, “আমি না কাটলে আরেকজন এসে কেটে নিয়ে যাবে।”
বাংলাদেশের বনভুমি রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যৌথ উদ্যোগে গঠিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রধান ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, কক্সবাজারের পাহাড়ে কিছু বিশেষ প্রজাতির গাছ; যেমন ঢাকিজাম, চাপালিশ, গর্জন, গামারি ইত্যাদি রয়েছে। এই প্রজাতির গাছগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
“আমরা দেখছি, রোহিঙ্গাদের আগমনের পর আশেপাশের এলাকাগুলো প্রায় বনশূন্য হয়ে পড়েছে। তাঁরা বড় গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। তাঁদের কোনো উপায় নেই, এটাও চরম সত্য,” বলেন ফরিদ।
ফরিদ আহমেদ আরও বলেন, প্রতিটি পরিবার যদি দিনে পাঁচ কেজি কাঠ পোড়ায় তাহলে এক লাখ পরিবার দৈনিক কমপক্ষে পাচ লাখ কেজি শুকনো কাঠ পোড়াচ্ছে। ভেজা অবস্থায় যার ওজন কমপক্ষে আট লাখ কেজি হবে।
তিনি বলেন, “প্রতিদিন যদি আট লাখ কেজি গাছ কাটা হয় তাহলে সহজেই বোঝা যায় কক্সবাজারের বন উজাড় হতে বেশিদিন লাগবে না।”
আরণ্যক ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান আরো বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিকল্প জ্বালানি দেয়াটা খুবই জরুরি। অন্যথায়, পুরো অঞ্চল বনশূন্য হলে পরিবেশ ও সেখানকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।”
বিষয়সমূহঃ
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম