ঢাকা বুধবার | ১৩ই মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে ফাল্গুন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আগামী নিউজ
২৮ নভেম্বর, ২০১৭ | ০৮:০১

কবিতার ত্রিভুজ সম্পর্ক

tesst

প্যারিসে নির্বাসিত সিরিয়ার কবি আদোনিস ঢাকা লিট ফেস্ট উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছিলেন সম্প্রতি। ১৬ নভেম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপর বাংলাদেশের কবি-অনুবাদক কায়সার হকের সঙ্গে তিনি আলাপে বসেন। সেই আলাপনের ভিত্তিতে লেখাটি গ্রন্থনা করেছেন প্রণব ভৌমিক

সিরিয়ার এমন এক গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, যেখানে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। ১৩ বছর বয়সে আমি গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। এর আগ পর্যন্ত বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণাও ছিল না।

বাবাই আমাকে প্রথম সাহিত্যের দুনিয়ায় নিয়ে আসেন; আরব শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। আরবি সুফি কবিতা সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা রাখতেন। বাসায় করতেন ক্যালিগ্রাফির চর্চা। বাবার কারণেই আমার এই সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবন।

তবে আমার মা দুজন। সম্ভবত আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যার দুজন মা। এক মা আমার গর্ভধারিণী, আরেক মা কবিতা। আমার প্রথম মা প্রকৃতির মতো। দ্বিতীয় মা সৃষ্টিশীলতা, যে আমাকে প্রকৃতির বাইরে গিয়ে বড় হতে সাহায্য করেছে। দুজনই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি বাইরে যেতে পারলেই মানুষ তার নিজের ইতিহাস তৈরি করতে পারে।

কিশোর বয়স থেকেই আমি কবিতা লিখতাম। সিরিয়ার স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আমাদের গ্রামে এলেন। তাঁকে আমি কবিতা পড়ে শোনালাম। এতে তিনি খুশি হয়ে আমাকে গ্রামের বাইরে একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।

আমি নানা রকম লেখা লিখতে শুরু করলাম। পাঠাতে শুরু করলাম বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে। কিন্তু কেউই আমার লেখা গ্রহণ করেননি, ছাপেননি। তখন আমি নতুন একটি নাম নিলাম—অাদোনিস। এই নামটি নেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম গ্রিক দেবতা অাদোনিসের পুরাগাথা থেকে। এক বন্য প্রাণীর আক্রমণে অাদোনিস মারা যায়। তার রক্ত থেকে জন্ম নেয় নতুন ফুল। এসব সাময়িকীপত্রের সম্পাদকেরাও আমাকে সেভাবেই আঘাত করেছিলেন। সে আক্রমণ থেকে জন্ম নেয় আমার নতুন কবিতা।

এভাবে আলী আহমাদ সায়ীদ এসবার থেকে আমি হয়ে গেলাম অাদোনিস। এবার আমি নতুন নামে লেখা পাঠাতে লাগলাম। তাঁরাও আমার লেখা ছাপাতে লাগলেন। এরপর আমি সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে লাগলাম। জীর্ণ পোশাকে আমাকে দেখে প্রথমে তাঁরা বিশ্বাস করেননি যে আমিই অাদোনিস। পরে পরীক্ষা করে প্রমাণ দিতে হলো। তাঁরা মেনে নিলেন।

সংস অব মিহিয়ার অব দামাস্কাস লেখার পর আমি বুঝলাম, রাজনীতির ওপর ধর্মের প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। আমার মনে হলো, ধর্ম ও রাজনীতি দুটো আলাদা থাকা উচিত। না হলে দুটোই দূষিত হয়ে পড়ে।

পবিত্র গ্রন্থগুলোর প্রচলিত যে ব্যাখ্যা আছে, তার বাইরে গিয়ে সেগুলোকে নতুন করে বোঝা জরুরি। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হতে হবে এই পাঠ। আমি ধর্মবিরোধী নই। কিন্তু আমি মনে করি, ধর্ম ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় হওয়া উচিত। তার বাইরে অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে এর যোগ থাকার দরকার নেই। আমি আরও মনে করি, সমাজ গড়ে উঠতে হবে তিনটি ভিত্তির ওপর—মানবাধিকার, মুক্তি ও নারী-স্বাধীনতা। অন্যের প্রতি সমাজ বা ব্যক্তির ব্যবহার ধর্মের ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। সেটি হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। তাই আমি আমার সাহিত্যিক কণ্ঠ দিয়ে অপেক্ষাকৃতভাবে আরও বেশি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তুলতে চাই।

আমার সমাজে কবিতা লেখা খুব ভালো চোখে দেখা হতো না। এ জন্য আমি নতুন সাহিত্যপত্র প্রকাশ করি। এর উদ্দেশ্য ছিল আরব সৃষ্টিশীলতার জমি আবিষ্কার করা। এই সাহিত্যপত্র আমাদের সুযোগ করে দেয় নিজেদের কবিতাচর্চার।

আমাদের সমাজের বড় সমস্যা পাঠে। ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাঠ আমাদের আবার নতুন করে নিতে হবে। নতুন করে পাঠ করতে হবে আমাদের সংস্কৃতিকেও। সে পাঠের পর আমাদের উপলব্ধি হয়েছে, প্রান্তিক সাহিত্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে সাহিত্য ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত, তার গুরুত্ব কম। সেগুলো কম কাব্যিক ও কম সৃজনশীল।

আমি দেখেছি, আরব কবিদের চেয়ে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান কবিরাই বেশি ধার্মিক। প্রথাগত ধর্মে আরব কবিদের চেয়ে বরং তাঁরাই বেশি বিশ্বাসী। আরব কবিতার মধ্যে সুফি আন্দোলন হয়েছে। এ আন্দোলন শুধু আরব কবিতাকে নয়, পৃথিবীকেও ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এতে একসঙ্গে দুটো ব্যাপার ঘটেছে। এ আন্দোলন আল্লাহর নতুন উপলব্ধি আমাদের সামনে উন্মোচন করেছে। একই সঙ্গে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নিয়ে নতুন ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এটি আমাদের কাব্যচর্চার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফসল।

আমরা উপলব্ধি করেছি, মানুষের আত্মপরিচয় আসলে কখনো তার পূর্বপুরুষ দেয় না। মানুষ সেটি তৈরি করে নিজে। এটি মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আর আমি শুধু আমাকেই পূর্ণ করি না। আমি তখনই পূর্ণতা পাই, যখন অন্যের সঙ্গে আমার যোগ তৈরি হয়। আমার আত্মবিকাশের জন্যই আমাকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের আত্মসত্তা আরও অন্য বহু মানুষের সত্তার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে।

আমাদের মধ্যে এই বিতর্ক ছিল যে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা কি জাতীয়তাবাদী হব নাকি আন্তর্জাতিকতাবাদী? আমরা সবার সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্কে গেলাম। একসময় দেখতে পেলাম, পশ্চিমের অধুনা আবিষ্কৃত পরাবাস্তবতা ভিন্ন চেহারায় এক-দেড় হাজার বছর আগে আরব সংস্কৃতিতে ছিল। এর মানে হলো, পশ্চিমই পরাবাস্তবের একমাত্র আবিষ্কর্তা নয়। সুফিবাদের পরাবাস্তবতা—যা আমাদের যুক্তিবোধ ও অস্তিত্বের বলয়ের ওপারে নিয়ে যেত—তা অনেক আগে থেকেই আরব সংস্কৃতিতে ছিল। এটা তাহলে বলা সম্ভব যে পরাবাস্তবের সঙ্গে সুফি ধারণার একটা যোগ আছে। সুফি ধারণাতেও বিশ্বাস করা হয় যে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাস্তবতার বাইরে আরেকটি বাস্তবতা আছে। এসব ভাবনা সম্ভবত একটি থেকে আরেকটি খুব বেশি দূরের নয়। এ কারণে পরাবাস্তববাদ ও সুফিবাদকে নতুন করে পাঠ করার দরকার আছে। এই পাঠের ফলে দুই ধারার সাহিত্যেই নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

আমি সবচেয়ে আগে নিজেকে মানুষ বলে মনে করি। বামপন্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানুষ। আর মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এক সত্তা। মানুষের অস্তিত্ব এক জায়গায় স্থির থাকে না। তাই এটি পরিবর্তিত হবেই। এটিই কাম্য। মানুষই ঠিক করে কী হবে তার বর্তমান, কী হবে তার ভবিষ্যৎ।

কবিতার সৌরভ কি অন্ধকারের শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে? কবিতার নিজস্ব শক্তি আছে। যদি বলি, দরজা আয়তাকার। এটি খুবই সাধারণ ও একরৈখিকভাবে বলা হলো। কিন্তু যদি বলি, এই দরজা একজন নারী, দু হাত বাড়িয়ে আমাকে সে ভেতরে আহ্বান করছে। তখন সেটি বদলে গেল, তার ভিন্ন মানে দাঁড়াল।

পৃথিবী, শব্দ ও কবির মধ্যে একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক আছে। কবিতা সব সময় আমরা এভাবেই তৈরি করি। শব্দ দিয়ে দৃশ্য তৈরি করা আমার কাছে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। এ দিক থেকে আরবি ভাষা রহস্যময়, এর একটি সংবেদনশীল সৌন্দর্য আছে। আছে প্রায় স্পর্শযোগ্য এক বাচিক সৌন্দর্য, যা আমাদের অভিব্যক্তি ও বোধবুদ্ধির ওপারের। তা শুধু অনুভব করা সম্ভব। সে ভাষাতেই আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দৃশ্য রচনা করি।

পুরো পৃথিবীকে যদি একটি ফুল হিসেবে কল্পনা করি, কবিতা তাহলে তার সৌরভ। আমার ধারণা, বেশির ভাগ মানুষ ফুলটি নিয়েই বেশি ভাবছে। ফুলের সৌরভ নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাজনীতি হচ্ছে সেই ফুল, যা নিয়ে আমরা সবাই চিন্তা করছি। এই ফুল টাকার, রাজনীতির ও ক্ষমতার।

আরব বসন্ত একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল আরব জনগণের জন্য। তবে একই সঙ্গে আমি বলব, এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি, যেভাবে তারা ওসামা বিন লাদেনকে তৈরি করেছিল। এটি এখন সবাই জানে। আরব বসন্ত আরব-সমাজের দারিদ্র্য উৎপাটন না করে দরিদ্রদের সমূলে উৎপাটিত করেছে। লিবিয়া, ইরাক, লেবাননের মতো দেশগুলো আরব বসন্তের কারণে আজ ধ্বংসস্তূপে পর্যবসিত হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের জন্যই আজ এ দেশগুলো বিপদে রয়েছে।

আরবি ভাষার যে মূল ভাব তা বেশির ভাগ আরব, বিশেষ করে আরব নেতারা বোঝেন না। তাঁরা বোঝেন না আরবি ভাষার মধ্যে কী সৃজনশীল, ঐশী ও সাহিত্যিক ভাব আছে। এটা আরব সাহিত্যের একটা বড় সংকট। মানুষ তার রাজনীতি বা অর্থনীতির মধ্যেই বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকে তার সৃষ্টিশীলতা ও সাহিত্যের মধ্যে। বর্তমান আরব দুনিয়া বিশ্বসাহিত্যকে কী দিয়েছে? কিছুই দেয়নি।

ধরুন একটি সভা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ও আরবদের প্রতিনিধিরা সেখানে আছে। যদি প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বসভ্যতায় কারা কে কী অবদান রাখছে? সভ্যতার উন্নয়নে তারা কী অবদান রেখেছে, তারা সবাই বলতে পারবে। সম্ভবত আরবদের বলতে পারার মতো কিছু থাকবে না। মিসর বা ব্যাবিলনের মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে যেতে পারেনি বলে তাদের অস্তিত্বও পরে লোপ পেয়ে গেছে।

আরব বিশ্বের পরিবর্তন দরকার। পশ্চিমা বিশ্ব আরব দুনিয়ার ওপর গভীর প্রভাব রাখছে। আরবদের তেল ও সম্পদ ভোগেই তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। সেখানকার সাংস্কৃতিক অবস্থার কোনো বিকাশ ঘটায়নি। ফলে আরবে পরিবর্তন এসেছে কেবল অর্থনীতির। সেখানে সংস্কৃতির কোনো বিনিময় হয়নি।

তবে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। অনেকে বলে থাকেন, তারা কম পড়ছে। কিন্তু আমার ধারণা, যেকোনো সময়ের চেয়ে তরুণেরা বেশি সংখ্যায় পড়াশোনা করছে। তাদের পাঠে গভীরতা আছে। পাঠ থেকে তারা ভিন্ন রকমের মানে বের করে আনতে পারে। পাঠের বিভিন্ন মাধ্যমও ভালো একটা ব্যাপার। এর মধ্য দিয়ে নানা ধরনের তথ্য সহজলভ্য হয়। তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আমি আশাবাদী।