ঢাকা সোমবার | ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মানুষ মানুষের জন্য
প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসে এশিয়ার সেরা সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশি দুই তরুণ ও তরুণীর নাম উঠে এসেছে । ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়া এই দুজনের একজন হচ্ছেন মিজানুর রহমান কিরণ। তিনি ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা।
জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০-এর ২৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এরই আলোকে বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিবন্ধী শিকষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বছরকয়েক আগেও এর চিত্র মোটামুটি ভিন্নই ছিল। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করে পিডিএফ (ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) নামক একটি সংগঠন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান কিরণ ২০০৮ সালে বন্ধুদের নিয়ে পিডিএফ নামক সেবাধর্মী এ সংগঠনটি গড়ে তোলেন। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ। তাকে এ কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ড. ভেলরি অ্যান টেলর।
এর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. এ টি এম আতিকুর রহমান।
প্রতিষ্ঠালগ্নে শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে সংগঠনটির পথচলা শুরু হলেও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাতটি পাবলিক ও দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে এর নিবন্ধনকৃত সদস্যের সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি।
২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণ প্রতিবন্ধীরা অংশগ্রহণ করতে পারলেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পারত না। তারাও যাতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেন পিডিএফের সদস্যরা। এর ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
পিডিএফের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ঢুকলেই চোখে পড়ে পিডিএফ শুধু একটি প্রথাগত সংগঠন নয়, নৈতিক আন্দোলনের নামও। এ থেকেই অনুধাবন করা যায় সংগঠনটির উদ্দেশ্য সমাজে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা।
সংগঠনটির অতীত ও বর্তমান কর্মকা- পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারা শুধু ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব শিক্ষার্থীর পাশে এসে দাঁড়ায়। বর্তমানে তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি একাডেমিক ভবনে র্যাম্প (হুইল চেয়ার নিয়ে উপরে ওঠার ঢালু সিঁড়িবিশেষ) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিভাগে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা বৃত্তি ও উপকরণ বিতরণ করে থাকে সংগঠনটি।
পিডিএফের সবচেয়ে বড় সফলতার ব্যাপারে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান কিরণ জানান, ‘আগে প্রতিবন্ধীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত না। আমরা এ সমস্যাটি অনুধাবন করতে পেরে এই নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে একটি রিট করি। শুনানি শেষে মহামান্য হাইকোর্ট আমাদের পক্ষে রায় দেন এবং সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীরাও অংশগ্রহণ করে। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য একটি বিরাট সফলতা।’
কেন এবং কীভাবে মানবতার মহান সেবায় জড়ালেন_ এ প্রশ্নের জবাবে কিরণ জানান, ‘আসলে ছোটবেলা থেকেই প্রতিবন্ধীদের প্রতি একটি আলাদা অনুভূতি কাজ করে আমার মধ্যে। তখন থেকেই মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল যে সমাজের এসব নিগৃহীত মানুষের জন্য কিছু একটা করা দরকার। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব অসঙ্গতি চোখে পড়লে আস্তে আস্তে কাজ শুরু করি যার ফল আজকের এই পিডিএফ।’
আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা গ্রীষ্মে একটা লম্বা ছুটি পায়। ২০১১ সালে আমরা চিন্তা করলাম, ওদের কীভাবে প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে সচেতনতার পাঠটা দিতে পারি। আমার তখনকার সেক্রেটারি আসিফ একটা প্রোগ্রাম ডিজাইন করে। যেটাকে আমরা এখন বলি, ‘পিডিএফ সামার চ্যালেঞ্জ’। এটার কনসেপ্টটা এমন—প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে সামার ভ্যাকেশনে একটা কম্পিটিশনের আওতায় আনি। যেটাকে আমরা বলি ‘কমিউনিটি সার্ভিস’। প্রথমে আমরা একটা টিম নির্ধারণ করি। ২৫টা টিম পঁচিশটা ইনস্টিটিউট থেকে আসে। প্রতিটা টিমে দল ১০টা। তাদের সঙ্গে ভলান্টিয়ার থাকবে ১০০ থেকে দুই শ’। আমরা ওদের ট্রেনিং দেই যে, কীভাবে প্রজেক্ট ডিজাইন করতে হয়। কীভাবে তহবিল গঠন করতে হয়। দেড় মাস ধরে তারা এসব কাজ চালাবে। দেড় মাস পর আমরা তাদের অ্যাওয়ার্ড দেব। এ প্রোগ্রামে আমাদেরকে ব্র্যাক, আমেরিকান অ্যাম্বাসি সাপোর্ট দেয়। এভাবে ২০১৫ পর্যন্ত চালিয়ে যাই।
এরমধ্যে আমাদের সামার চ্যালেঞ্জের অনেক ছেলেমেয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে যায়। কানাডায় থাকা একজন জানাল, টরেন্টোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্বপন চৌকিদার। তিনি আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তিনি জানালেন, জুডিশিয়ারি এবং বিসিএসে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চাকরির সুযোগ নেই। কারণ, মেডিক্যাল টেস্টে প্রতিবন্ধীরা বাদ পড়ে যায়। তিনি আদালতে রিট করতে চান। স্বপন চৌকিদারের রিটের সময় আমরা পাশে দাঁড়ালাম। আমাদের সঙ্গে ব্লাস্ট যোগ দিল। এডিডি যোগ দিল। আমরা মানববন্ধন করলাম। গোলটেবিল বৈঠক করলাম। ২০১৩ সালে বিসিএসে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা নিশ্চিত হয়।
আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং আইনের ছাত্র। তিনি জানালেন, পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি পেতে সমস্যা। তখন আমরা ব্র্যাকে কথা বললাম। সেখান থেকে জানানো হলো, ব্র্যাকে বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেওয়া হয়েছিল। নানা কারণে; বিশেষত দক্ষতাজনিত সমস্যায় তারা টিকতে পারেনি।
আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রতিবন্ধীদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখলাম, প্রতি একশ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৬ জনের ব্যক্তিগত কম্পিউটার আছে। তাই আমরা প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটারে দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগ দিলাম। একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা তাদেরকে সফট স্কিলস ট্রেনিং দিতে শুরু করলাম। সেশনগুলোতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্টরা এসে কথা বলেছেন। এতে করে কে কোন কাজের জন্য দক্ষ, তা তারা বুঝতে পারে। সেই অনুযায়ী পেশা বাছাই বা লক্ষ্য ঠিক করতে সহজ হয়। পাশাপাশি কম্পিউটার ট্রেনিং দিতাম। এজন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব ব্যবহার করতাম।
এরপর আমরা কর্পোরেট জগতের লোকদের নিয়ে একটা ‘ক্যারিয়ার এক্সপো’ করি। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী তরুণরাও আসে। আমরা তাদের সিভিগুলো তুলে ধরি। যাতে দক্ষতা অনুযায়ী তারা চাকরি পায়।
২০১৬-তে আমি আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাই। আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের জন্য কীভাবে কাজ করছে, তা দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কারণ, আমরা ভালোবাসা থেকে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এ কাজে আমাদের অ্যাকাডেমিক জ্ঞান নেই। আমি ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। আমেরিকায় যেটা দেখলাম—ওরা প্রতিবন্ধীদের ‘দক্ষতা’কে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এজন্য আমরা (পিডিএফ) একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেছি। আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মো. জাহিদ হাসান। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিসার্চ ফেলো। নোবেল কমিটির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন তিনি।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি ও দক্ষ প্রতিবন্ধী তরুণদের কাজের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা একটি ইনস্টিটিউট গড়ার দিকে এগুচ্ছি। সেখানে প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তারপর যার যার দক্ষতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে চাই। মানে সে একজন দক্ষ লোকের সঙ্গে ফ্রি কাজ করবে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাকে চাকরি দেবে।
বর্তমানে আমরা একটা অ্যাপস ডেভেলপড করেছি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এই অ্যাপসের মাধ্যমে সহায়তা চাইবে। অ্যাপসে আমাদের ভলান্টিয়ারদের রেজিস্ট্রেশন করা থাকবে। তাদের কাছে ম্যাসেজ চলে যাবে। তারা তখন ওই শিক্ষার্থীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসবে। এই অ্যাপসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সেবাদানকারীকে পরবর্তী সময়ে ‘বেস্ট ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হবে।
প্রতিবন্ধীসহ সকল তরুণদের আরেকটা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিশ্বব্যাংকের একটি ডাটায় বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের অর্ধেক চাকরির বাজার হবে দক্ষিণ এশিয়ায়। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এসব চাকরি হবে ডিজিটাল সেক্টরে। দেশের সরকারসহ এনজিওগুলো যদি সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে, আমি বিশ্বাস করি সাধারণ তরুণদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের কাজেরও অনেক সুযোগ তৈরি হবে। সূত্র: যায়যায়দিন ও ইত্তেফাক
বিষয়সমূহঃTags: পিডিএফ, প্রতিবন্ধী, মানবিকতা, মিজানুর রহমান কিরণ
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম