ঢাকা শনিবার | ১৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করে সফল হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে জামিনের জন্য আইনি লড়াই করাটা খালেদা জিয়ার জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, আইনি প্যাঁচে এমনিতেই খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। এর ওপর হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ বহাল রাখার পাশাপাশি ওই মামলায় খালেদা জিয়ার আপিল আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আপিল নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা নির্ধারিত হওয়াটা খালেদা জিয়ার জন্য অসুবিধাজনক হিসেবেই দেখছেন আইনজ্ঞরা। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কথায়ও তেমনই আভাস মেলে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া জামিন পেলেও অন্য কয়েকটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোয় এ মুহূর্তে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। যেসব মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কিংবা নিম্ন আদালতে হাজির করার জন্য পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সেগুলোতে জামিনের জন্য আলাদাভাবে আইনি লড়াই করতে হবে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে। উপরন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার করা আপিল নিষ্পত্তির জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টকে ওই আপিল নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল বহাল রাখার পাশাপাশি ওই নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরই মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের ওপর শুনানির প্রস্তুতি নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আপিল বিভাগের রায়ের কপি পাওয়ার পরপরই দ্রুত ওই শুনানির জন্য উদ্যোগ নেবে তারা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হওয়ার পর কারাগারে যেতে হয়েছে বিএনপি প্রধানকে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় তাঁর জামিনের জন্য আবেদন করা হয়েছিল হাইকোর্টে। সেই আবেদনের ফল ইতিবাচক হলেও এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আপিলের পর সর্বোচ্চ আদালত জামিন বহাল রেখে খালেদার আপিল নিষ্পত্তি করার সময়সীমা ঠিক করে দিয়েছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আপিল বিভাগ সময় বেঁধে দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য অসুবিধার সৃষ্টি হলো। তিনি বলেন, ‘কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না যে মামলায় খালেদা জিয়া খালাস পাবেন, নাকি তাঁর আপিল খারিজ হবে। যদি তাঁর আপিল খারিজ হয়ে যায় তাহলে তো অসুবিধা হবেই। আর খালাস পেলে তো বেঁচেই গেলেন।’
বিএনপিপন্থী অনেক আইনজীবীই মনে করেন, আপিল বিভাগের ওই নির্দেশ খালেদা জিয়ার জন্য খারাপই হয়েছে। এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এই খারাপ দিকটা ভাবা হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকা অবস্থায় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে আপিলের শুনানি শেষে যদি খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকে তাহলে ওই নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়া ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকলে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন তিনি। তাঁরা মনে করছেন, তাড়াতাড়ি কারামুক্তির চেষ্টা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে খালেদা জিয়ার জন্য।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি হলে সেই রায় প্রভাব ফেলবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। খালেদা জিয়ার সাজা বহাল থাকলে তাঁর আইনজীবীদের দ্রুত আপিল বিভাগে আপিল করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ বা দুদক তা দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেবে, যেমনটি করছেন হাইকোর্ট বিভাগে। তাতে সাজা বহাল থাকলে খালেদার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রশ্নের মুখে পড়বে।
সংবিধান অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দুই বছর বা তার অধিক সাজা হলে এই সাজা ভোগ শেষে পরবর্তী পাঁচ বছর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না; যদি (ঘ) ‘নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’
গত ১৬ মে খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে আপিল বিভাগ রায় দেওয়ার পরপরই রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবীরা বলেন, ওই রায়ের কপি পাওয়ার পর দ্রুত আপিল নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে। গতকাল শনিবার ওই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের কপি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাইকোর্টে শুনানির উদ্যোগ নেবেন তাঁরা।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আপিল বিভাগ জামিন আবেদনের বিষয়ে রায় দিতে গিয়ে আপিল নিষ্পত্তির জন্য সময় বেঁধে দেওয়া সমীচীন হয়নি বলেই মনে করি। যেখানে হাইকোর্ট বিভাগে এখনো হাজার হাজার পুরনো আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগ যেকোনো আদেশ নির্দেশ দিতেই পারেন। আপিল বিভাগের রায় একটা আইন। সেটা মানা সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক। আর এ কারণে আপিল বিভাগের রায় এমন হতে হবে যাতে সকলের জন্যই তা সমান হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগে এখন অনেক পুরনো আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এ কারণে অনেককেই কারাগারে বন্দি থাকতে হচ্ছে। তাঁদের আপিল যদি দ্রুত নিষ্পত্তি হতো, আর যদি সংশ্লিষ্ট আসামিরা খালাস পান তাহলে তাঁদের আপিল শুনানির দীর্ঘসূত্রতার কারণে কারাবন্দি রাখা হবে বেআইনি। খালেদা জিয়ার আপিল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে খালেদা জিয়ার আপিল শুনানি হবে আগেই। এ কারণেই আপিল বিভাগের রায়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে যে যাদের আপিল বছরের পর বছর বিচারাধীন রয়েছে তাদের প্রতি অবিচার করা হলো কি না? উত্তর হতে পারে এমন যে অবিচারই হয়েছে। কিন্তু আইন তো সবার জন্য সমান হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।’
বিষয়সমূহঃ
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম