ঢাকা বৃহস্পতিবার | ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আগামী নিউজ
২৮ নভেম্বর, ২০১৭ | ০৬:৫৩

মাত্র ৮ ঘণ্টায় ২৫০০ কোটি টাকার ডিপিপি পুনর্গঠন

tesst

অবিশ্বাস্য গতিময় দিন হিসেবে চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনে মাত্র ৮ ঘণ্টায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিতর্কিত ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ’ (এমওটিএন) প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করেছে বিটিসিএল! অবশ্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে দেওয়া চিঠিতেও সে রকম নির্দেশই ছিল। প্রকল্পের মূল ডিপিপি এবং পুনর্গঠিত ডিপিপিতে ব্যয়ও রয়েছে একদম সমান সমান! অর্থাৎ অবিশ্বাস্য গতিময়তার ডিপিপি পুনর্গঠনে ব্যয় পর্যালোচনার সুযোগই পায়নি বিটিসিএল-সংশ্নিষ্টরা!

বিটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, এভাবে এক কার্যদিবসে এত বড় প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠনের ঘটনা নজিরবিহীন। এর আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক ব্যয়ের কারণে চড়া সুদের এই ঋণ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সমকালসহ একাধিক গণমাধ্যমে প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় নির্ধারণ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পরে গত ১৭ অক্টোবর একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেও যুক্তিযুক্তভাবে ব্যয় কমানোর জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন এবং প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া একনেক সভায় প্রকল্পটিকে চীনা বিশেষ ছাড়ের (কনসেশনাল) ঋণের প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করা হলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, প্রকল্পটির ঋণ ‘অনমনীয়’। এ নিয়েও দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

এত গতিময়তা যেভাবে এলো : অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২ নভেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বিটিসিএলে পাঠানো চিঠিতে প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠনসহ প্রকল্পের ব্যয় কমাতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ’ প্রকল্পে প্রাক্কলিত মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। অনুমোদিত প্রকল্পে যুক্তিযুক্তভাবে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে চীন সরকার মনোনীত সংশ্নিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবকে সভাপতি করে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করতে হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, একনেকের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গৃহীত ব্যবস্থার প্রত্যয়নসহ প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠন করে সেটির পরিচ্ছন্ন ১৪টি কপি এনইসি-একনেক ও সমন্বয় অনুবিভাগে পাঠাতে হবে। প্রতি পৃষ্ঠায় এবং নির্ধারিত স্থানে স্বাক্ষরসহ পুনর্গঠিত ডিপিপির মূলকপি এবং সিডি পাঠানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এ চিঠিতে।

এ চিঠি পাওয়ার প্রায় দেড় সপ্তাহ পর গত ১৩ নভেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে বিটিসিএলকে একনেকের নির্দেশ অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। পুনর্গঠনের পর সেটি একই দিনে অর্থাৎ ১৩ নভেম্বরেই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বিটিসিএল একই দিনে ডিপিপি পুনর্গঠন করে তা পাঠিয়ে দেওয়ার কথা পৃথক চিঠিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে জানায়। বিটিসিলের পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, পুনর্গঠিত ডিপিপির মোট ব্যয় আগেরবারেরই সমান অর্থাৎ দুই হাজার ৫৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা! এর অর্থ অবিশ্বাস্য গতিময়তায় ডিপিপি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যয় পর্যালোচনা করা হয়নি!

এভাবে এক কার্যদিবসে প্রায় তিনশ’ পৃষ্ঠার ও আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ঋণ প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠনের ঘটনা নজিরবিহীন। অন্তত বিটিসিএলের ইতিহাসে এত অস্বাভাবিক গতিতে ডিপিপি সংশোধনের নির্দেশ এবং তা বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।

অনমনীয় ঋণ কমিটির অনুমোদন নিতে হবে : অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, গত ৭ নভেম্বর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, এমওটিএন প্রকল্পের জন্য বিবেচ্য চীনা ঋণ অনমনীয়। তাই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে অনমনীয় ঋণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন। অথচ এর আগে ১৭ অক্টোবর একনেক সভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত বক্তব্যে প্রকল্পের জন্য বিবেচ্য ঋণকে চীন সরকারের ‘কনসেশনাল লোন’ বা ‘বিশেষ ছাড়ের ঋণ’ বলা হয়েছিল।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, গত ৩০ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে প্রকল্পটিতে অনুমোদন দেওয়ার কথা জানানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে। তবে আনুষ্ঠানিক এ চিঠি আসার আগেই ২৪ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে একনেকে প্রকল্প অনুমোদনের তথ্য ঢাকার চীনা দূতাবাসকে জানানো হয়।

প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়ের কয়েকটি চিত্র : বিটিসিএলের বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা ছয় লাখের নিচে। অথচ এ প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে ১৮ লাখ গ্রাহকের জন্য। এর আগেও অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে একই সঙ্গে টেলিফোন, ইন্টারনেট ও টেলিভিশন (ট্রিপল প্লে) সংযোগের জন্য এভাবে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা সেসব যন্ত্রপাতি গত চার বছরেও কার্যত অব্যবহূত রয়ে গেছে। একই ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের হিসাব আবারও রাখা হয়েছে প্রকল্পে।

প্রকল্পে গ্রাহক পর্যায়ের ‘জিপন’ যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে প্রতিটি ১০১ ডলার দামে। যদিও এর বাজারমূল্য ৪৫ ডলার। এর আগে জাইকার অর্থায়নে একই ধরনের একটি প্রকল্পে সারাদেশে এক হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার কেবল বসানোসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির জন্য দর প্রস্তাব ছিল দুই কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ২২৪ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার ছিল মাত্র দশমিক শূন্য এক শতাংশ। বিটিসিএল তখন প্রকল্পের ব্যয় ২২ শতাংশ বেশি অজুহাতে এর বাস্তবায়ন বন্ধ রাখে। অথচ বর্তমানে দুই শতংাশ সুদে ‘অনমনীয়’ চীনা ঋণের একই ধরনের প্রকল্পে এক হাজার ২৪০ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক কেবলসহ আরও প্রায় এক দশক আগের পুরনো প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দাম ধরা হয়েছে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ২৮০ কোটি টাকা! এ ছাড়া এ প্রকল্পে বৈদ্যুতিক পাখাসহ ছোটখাটো যন্ত্রপাতি কিনতেও লাখ টাকার বেশি দর ধরা হয়েছে।