ঢাকা সোমবার | ২৫শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সুমন কুমার দাস
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ | ১১:৩২

সাঘাটার উজ্জ্বল নক্ষত্র ‘ফটোআপা’

tesst

সাঘাটা উপজেলার সুলতানা শামীম আরা বেগম। তাঁর পেশা শিক্ষকতা হলেও সাধারণ মানুষ তাঁকে চেনে অন্য নামে। তিনি সমাজের অবহেলিত, স্বজনদের মমতাবঞ্চিত বৃদ্ধ নারীদের সেবা করে ‘ফটো আপা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ফজরের নামাজ পড়েই তিনি তাঁর কচুয়াহাটের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় প্রতিদিন বেরিয়ে পড়েন। খোঁজখবর নেন আশপাশের অসহায় বৃদ্ধাদের। ফটো আপার উপস্থিতি মানেই জীবনের দুঃখ-ব্যথা মন খুলে বলা। আনাবি, কস্তুরি আর ছমিরন বেওয়ারা হাসি-কান্নার ঝাঁপি খুলে বসেন একসাথে। তাঁদের সাথে হাসেন, কাঁদেন ফটো আপাও। মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁদের সমস্যার কথা শোনেন। তারপর বাসায় ডাকেন, নিজের চেষ্টায় যতটা পারেন, সমস্যার সমাধান করে দেন। গত ১০ বছর ধরে এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন উপজেলার শত শত বয়স্ক নারী। সরেজমিনে জানা গেছে, সাদাসিধে নিরহংকারী ফটো আপার নানা কাহিনী। কোনো উচ্চাভিলাষ নেই তাঁর। সামাজিক কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়। বাবা ডা. শামছুজ্জোহার স্বপ্ন ছিল মেয়ে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে। কিন্তু ১৯৮০ সালে ম্যাট্রিকে অসুস্থতার কারণে ফল তেমন ভালো না হওয়ায় অনেকটাই ভেঙে পড়েন শামীম আরা। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৬ সালে বিয়ে হয় অধ্যাপক আব্দুল রাজ্জাক ম-লের সাথে। বিয়ের সাত দিন পর কচুয়াহাট শহীদ এইচ আর এম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁদের সংসারে এক মেয়ে ও এক ছেলে। দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ফটো আপা ২০১২ সালে স্নাতক পাস করেন। তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল একটি হাসপাতাল গড়ে বাবা-মেয়ে মিলে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু ২০০৪ সালে হঠাৎ বাবা মারা যান। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ফটো আপা ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বৃদ্ধ নারীদের কল্যাণে কাজ শুরু করেন। নিজের টাকায় বাড়ির পাশের ধনারুহা গ্রামে ১১ শতক জমি কিনে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে পাঁচটি কক্ষ, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগসহ সব ধরনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালে সেখানে গড়ে তোলা বৃদ্ধাশ্রমের নাম দেন ডা. শামছুজ্জোহা মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম। ফটো আপার সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশেষ করে স্বামী, সন্তানহীন এবং নিরাশ্রয় এমন বৃদ্ধাদের চিকিৎসায় নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সাথে সমন্বয় করে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৭ থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক’শ বৃদ্ধাকে সহায়তা করেছেন ফটো আপা। সহায়তা করেই ক্ষ্যান্ত নন তিনি। তাঁরা কেমন আছেন, তা জানতে বৃদ্ধশ্রমে বসে সাপ্তাহিক বৈঠক। ফটো আপা বলেন, ‘আমার স্বামীর টাকায় সংসার চলে। আর নিজের বেতনের টাকাসহ জমিজমার আয় দিয়ে বৃদ্ধ নারীদের কল্যাণে কাজ করছি। কিন্তু অর্থ সংকটে শুরু করতে পারছি না বৃদ্ধাশ্রমের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। তাই শুধু পরামর্শ আর সাহায্য কেন্দ্র হিসেবে সেটি চলছে। জনপ্রতিনিধিসহ অনেক বড় মানুষ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। তবু আশা ছাড়িনি। যেখানেই যাই বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে সহযোগিতা প্রার্থনা করি।’ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ফটো আপা মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ২৯টি কমিটির সভাপতি, সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বৃদ্ধাদের সহায়তার পাশাপাশি তিনি বাল্যবিয়ে রোধ, গ্রামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং শিক্ষা, সামাজিক কাজের জন্য জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৩টি পুরস্কার পেয়েছেন। সেবাপাগল এ মানুষটি তাঁর বৃদ্ধাশ্রমে ৩০ থেকে ৩৫ জন এতিম শিশুর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। বয়স্ক নারীদের শেষ মুহূর্তগুলোকে একটু আনন্দে ভরিয়ে দিতে বৃদ্ধাশ্রম খোলার স্বপ্ন ফটোআপার। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা কতোটুকু সহায় হবে-এ ব্যাপারে সন্দিহান উপজেলার সকল নারী ও পুরুষ।

লেখক: কমিউনিটি ফেলো, রেডিও সারাবেলা।

বিষয়সমূহঃ