ঢাকা রবিবার | ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নাজমুস শাহাদাৎ:
কয়কেটা দিন অসহনীয় গরমের পর সোমবার (২৩ জুলাই) রাজধানীসহ মোটামুটি সারাদেশেই নেমে আসে স্বস্তির বৃষ্টি। বৃষ্টিতে প্রকৃতি শীতল হয়ে এলেও সেই বৃষ্টিতে তোলা একটি ছবি নিয়ে রীতিমত সরগরম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক।
ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’তে এক যুগলের বৃষ্টিস্নাত চুম্বন দৃশ্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সমালোচনাও কম হয়নি। আর এই আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন জীবন আহমেদ নামের এক ফটো সাংবাদিক।
সোমবার (২৩ জুলাই) দুপুরে বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাসে ওই তরুণ-তরুণীর এমন একান্ত মুহূর্ত ক্যামেরায় ধারণ করেন জীবন আহমেদ। পরে তিনি ছবিটি ‘বর্ষা মঙ্গল কাব্য, ভালোবাসা হোক উন্মুক্ত’ ক্যাপশনে নিজের ফেসবুক পেইজে পাবলিক পোস্ট হিসেবে শেয়ার করেন।
বৃষ্টিস্নাত এই যুগলের ছবিটি ধারণ করার আগে বা পরে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, বিশেষ করে এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের কোনো অনুমোদন আছে কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
এ বিষয়ে জীবন আহমেদ জানান, তিনি এই ছবিটি তোলার সময় বা ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা নিয়ে ওই জুটির কারো কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেননি।
জীবন আহমেদ বলেন, ‘তবে ওই যুগল দেখতে পেয়েছেন যে তাদের ফ্রেমবন্দী করা হচ্ছে এবং ছবি তোলা হচ্ছে জেনেও এ বিষয়ে তারা কোনো আপত্তি জানাননি।’
আপত্তি না জানানোকে অনুমোদন ভাবা কতটা যৌক্তিক—এমন প্রশ্নের জবাবে জীবন বলেন, ‘পোস্টটি দেওয়ার সময় ভাবতেও পারিনি এটি এমনভাবে ভাইরাল হয়ে যাবে।’
পরে জীবন আহমেদ নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে ছবিটি সরিয়ে নিলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ, ততক্ষণে যা হবার তা হয়েই গেছে।
এদিকে, কারো এমন ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ধারণ এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের আগে ওই ব্যক্তির অনুমোদন নেওয়ার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক।
সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘এ ধরনের ছবির কারণে ওই দুইজন সামাজিকভাবে নানা সমস্যার মুখে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ছবি তোলার মুহুর্তে না হলেও, ছবিটি তোলার পর অবশ্যই তাদের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল। কেননা, এই ছবির সঙ্গে ওই দুজনের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।’
অন্যদিকে, টিএসসি’তে প্রকাশ্যে একে অপরকে চুম্বনের এই ছবি নিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা মন্তব্য।
অনেকেই দুষছেন ফটোগ্রাফারকে। অনেকেই বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধ টেনে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। ফটোগ্রাফারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি জনসমাগম স্থানে এভাবে আবেগের বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন কেউ কেউ।
তাওহীদ নিশান নামের একজন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একটা সম্পর্কের মধ্যে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে সেটার প্রাইভেসিও থাকা উচিত।’
আতিকুর রহমান তমাল নামের আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘তারা কি চেয়েছেন, কেউ ছবি তুলুক আর সবাই সেটা ভাইরাল করুক? যদি না চান তাহলে আপনার উদারতা তাদের জন্য বিব্রতকর।’
আবার কেউ এই ছবিকে ভালোবাসার নিষ্পাপ অভিব্যক্তি আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করেছেন।
অমিত শীল অমি লিখেছেন, ‘দুর্নীতি করলে কিছু হয় না, ফেসবুক সরগরম হয় ভালোবাসার প্রকাশ করলে।’
ফারজানা সুমনা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম ভালোবাসার কারণে রসাতলে যায় না। ঘৃণার কারণে যায়, বিবাদ-বিসংবাদের কারণে যায়।’
অনেকে আবার এটাকে অশ্লীলতা ও যৌনতার দৃষ্টিতে দেখে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে কলেজের লেকচারার মেরিনা নাসরিন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চুম্বন দৃশ্যের ছবি দেখে যারা ছ্যাঃ ছ্যাঃ করছেন আমার মতে পার্টনার বা জুটি হিসেবে তারা খুবই বিরক্তিকর।
এই দৃশ্যে যৌনতা কোথায় দেখলেন মশাই? আমি তো মিষ্টি প্রেম ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। আপনি রাস্তায় রক্তারক্তি দেখতে পারেন, খুন দেখতে পারেন, নারী শিশু এবিউজ, ঘুষ দুর্নীতি দেখতে পারেন, চুমু দেখতে দোষ? আপনি ঘরের কোণে বসে রেগুলার পর্ণ সাইট ব্রাউজ করছেন, চটি পড়ছেন উস্কানি পেয়ে কোন কোন সময় ঘরে বাইরে এবিউজের মত গোপন অপরাধ করছেন। তাতে ঘেন্না নেই এই দৃশ্যে ঘেন্না?
আপনি দিনেদুপুরে পর্দাঘেরা রিকশা সইতে পারেন, লিটন ভাইয়ের ফ্ল্যাট সইতে পারেন ভালবাসার প্রকাশ সইতে পারেন না, এ ভারী অন্যায় মশাই’!
এ ছাড়া ছবিটির সত্যতা নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি। অনেকেই কাছাকাছি সময়ে একই স্থান থেকে আরও কয়েকটি ছবি তুলে দাবি করেছেন যে, ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড কয়েক লেয়ারে পরিবর্তন করা হয়েছে। ছবিটি ফটোশপে তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি করেন অনেকে।
এমন দাবি অস্বীকার করেছেন আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ, তিনি জানান, এই ছবিটিতে কোনো ধরনের এডিট করা হয়নি। ছবিটি তুলতে তিনি বিশেষ ধরনের লেন্স ব্যবহার করেছেন, সে কারণে ব্যাকগ্রাউন্ডটা কিছুটা ভিন্নভাবে এসেছে।
যাইহোক, ভাইরাল হওয়া এই চুম্বন দৃশ্যটি নিয়ে গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মত্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চুম্বনরত একটি জুটির ছবি এটি। এই ছবি নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে আমাদের সাংস্কৃতিক চিন্তা। কেউ ছবিটিকে ভালোবাসার সিম্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, অন্যরা বিৃকতির।
চুম্বন কোনো দোষের বিষয় নয়। কিন্তু এর সামাজিক প্রেক্ষাপট আর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। প্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমের সংস্কৃতিগত পার্থক্য অস্বীকার করা যাবে না। আর দ্বিমতটা সেখানেই। প্রকাশ্যে চুম্বন হয়তো পশ্চিমে কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু প্রাচ্যের সংস্কৃতি এটাকে মেনে নেয় না।
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র চুম্বনকে কামকলার অন্তর্ভুক্ত করেছে। দুটি যুবক-যুবতীর চুম্বন কামকলারই অংশ। আর কামকলা কোনো প্রকাশ্য বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় মানুষের সংস্কৃতির আশি ভাগই ধর্ম কেন্দ্রিক। ভারতীয় সমাজ এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ সেভাবেই টিউনড। অষ্টম শতকে উপমহাদেশে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধর্ম হিবেবে ভারতীয় ধর্মসৃষ্ট সাংস্কৃতিক আচারের অনেকটাই সংস্কার করে ইসলাম। কিন্তু ইসলামও প্রাপ্তবয়ষ্ক নারী-পুরুষের প্রকাশ্য চুম্বনে সায় দেয়নি। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এটাকে স্বভাববিরুদ্ধ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে।
বিষয়সমূহঃ
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম