ঢাকা রবিবার | ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
হঠাৎ বদলে যাচ্ছে বিএনপির রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছিল দলটি। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিচারাধীন মামলাগুলোর বিচারকার্যের গতি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে দলীয় রোডম্যাপ। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় হবে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়ও হবে শিগগির। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন দলের নেতাকর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে নতুন কৌশলও নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
নেতারা জানান, মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে এবং নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা অনুকূলে না এলে নতুন কৌশল নির্ধারণ করবে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ইতিবাচক রাজনীতির কৌশল থেকে সরেও আসতে পারে দলটি। আবারও হার্ডলাইনে গিয়ে রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে পারে তারা। এরই মধ্যে নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে যার যার মতো নেতৃত্ব দিয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
দলের শীর্ষ নেতারা জানান, নতুন বছরের শুরুতে খালেদা জিয়ার বিভাগীয় সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। একই সঙ্গে সম্প্রতি ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলেও স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন শরিক দলের শীর্ষ নেতারা।
পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারেও নতুন করে ভাবছে বিএনপি। নিজেদের দাবির প্রতি সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেনি প্রতিবেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্র। দেশটির ক্ষমতায় পরিবর্তন হওয়ায় কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল বিএনপি। সবার আগে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আগের সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকেই অনুসরণ করছে বর্তমান সরকারও। এ মনোভাব লক্ষ্য করে কিছুটা হতাশ বিএনপি হাইকমান্ড। তার পরও তাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আরও জোরালো লবিংয়ের পাশাপাশি নতুন করে বিকল্প চিন্তাও করছে হাইকমান্ড।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় প্রায় প্রতিদিনই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এতে সার্বিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিঘ্ন ঘটছে। খালেদা জিয়ার বিভাগীয় সফরসহ কোনো কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তড়িঘড়ি করে একটি মামলার রায়ের তারিখও ঘোষণা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্নেষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নৈতিকতা বলে একটি কথা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে, বিরোধী দলকেও সমান সুযোগ দিতে হয়। দেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল নির্বিঘ্নে সারাদেশে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। আর বিরোধী দলকে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা উচিত, যেটা পৃথিবীর অনেক দেশই করে থাকে।
সূত্র জানায়, দলের ‘অস্তিত্ব রক্ষা’য় আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় বিএনপি। বিগত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো আর ভুল করতে চায় না তারা। সরকারের নানা হয়রানি ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের মুখেও হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে নেতাকর্মীদের ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলারও নির্দেশনা রয়েছে। পাশাপাশি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে’ ভোটযুদ্ধে লড়তে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরি, দলের সম্ভাব্য প্রার্থী জরিপ, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, ২০ দলীয় জোটের বাইরে দলগুলোকে নিয়ে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়া, দলের সংস্কারপন্থিদের ফেরানো, তৃণমূল থেকে দল পুনর্গঠনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। এরই মধ্যে ভেতরে ভেতরে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান দুটি দুর্নীতির মামলার বিচারকার্যে ঘন ঘন হাজিরা ও রায়ের তারিখ ঘোষণায় দলের নীতিনির্ধারক নেতারা নড়েচড়ে বসছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজনৈতিক ও আইনি প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন তারা। নতুন বছরের প্রথম ছয় মাস রাজপথে নামার পরিকল্পনা না থাকলেও মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে কঠোর কর্মসূচি দেবে দলটি। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতির চেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রাজপথে নামার বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছে হাইকমান্ড।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দলের চেয়ারপারসনসহ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। খালেদা জিয়াকে সপ্তাহের ছুটির দু’দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তার পক্ষে আপাতত আর বিভাগীয় সফরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খালেদা জিয়া যাতে দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর সামনে যেতে না পারেন, পরিকল্পিতভাবে এ কাজ করছে সরকার।
বিএনপির নীতিনির্ধারক একাধিক নেতা জানান, সরকারের কূটকৌশল মোকাবেলা করতে তাদের নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। নতুন সব পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে হোমওয়ার্ক চলছে। বিএনপির সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির সঙ্গে দেশের মানুষ রয়েছে। আর এটা বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগ রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে চায়। তাই বিএনপির সঙ্গে সংলাপেও বসতে রাজি হচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শিগগির রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিভাগীয় সফর শুরু করবেন। আর বিএনপি চেয়ারপারসনকে মামলার বেড়াজালে ফেলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তবে এর মধ্যেও শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে উত্তরবঙ্গ সফরে যাবেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে সরকারি দল। দলের চেয়ারপারসনকে মামলার জালে আটকে সাংগঠনিক ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের যাবতীয় প্রস্তুতিতে বিঘ্নিত করা হচ্ছে।
বিষয়সমূহঃTags: বিএনপি
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম