ঢাকা বুধবার | ২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আগামী নিউজ
২ ডিসেম্বর, ২০১৭ | ১৯:৩৩

আনিসুল হককে আমি অপছন্দ করতাম

tesst

আনিসুল হককে আমি অপছন্দ করতাম। হিংসা করতাম। এই লোকটিকে দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। এই লোকটিকে নিয়ে কোথাও কথা শুরু হলে মনোপীড়নে ভুগতাম। আমার কাছে মনে হতো আনিসুল হক অসহ্য এক খলনায়ক।

আমার প্রেমিকারা, আমার কলেজ-ভার্সিটির সপ্রতিভ সহশিক্ষার্থিনীগণ, আমার প্রিয়দর্শিনী সহকর্মীগণ এই লোকটিকে মনে মনে নিজেদের ভাবতো। এই লোকটি আমার উন্মাতাল প্রেমিক জীবনে হস্তক্ষেপ করে যেতো। যাদের প্রতি ক্র্যাশড ছিলাম তারাই দেখতাম আগেভাগেই আনিসুল হকের উপর ভরপেট ক্র্যাশ খেয়ে বসে আছে। হা হতোশ্যি!

বলতাম, সে তো তোমাদের চেয়ে বছর বিশেকের বড় হবে। জবাব শুনতাম, ‘তো?!’

এই জবাবে আনিসুল হকের কিছু যায় আসতো না। আমার যায় আসতো। অবচেতন মনে এই লোকটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতাম। আমার প্রতিটি প্রেমকেই ট্র্যায়াংগল মনে হতো আর মনে মনে এই পুরুষটির নাছোর উপস্হিতিকে ঘৃণা করতাম।

আনিসুল হকে হেলেনি শিল্প-সাহিত্য-মিডিয়ায় এমন মেয়ে কম ছিল। আমি এবং আমার মতো অনেক যুবক তার এই অদৃশ্য হস্তক্ষেপে বিধ্বস্ত হয়ে যেতাম, ম্রিয়মাণ হয়ে পড়তাম। কথায় কথায় এই লোকটির কথা উঠলে খেয়াল করতাম মেয়েদের চেহারা বদলে যাচ্ছে, তারা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠছে, এবং তারা তাদের সংগে থাকা ছেলেদের ব্যাপারে অমনযোগী হয়ে পড়ছে। আমি মনে মনে আমার এই অপছন্দের লোকটি হতে চাইতাম।

আচ্ছা, এই আনিসুল হকটা যদি না থাকতো! কী সহজই না হতো সবকিছু! কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে দাঁড়াতে হবে, দুটি মাত্র চোখ দিয়ে কিভাবে একই সঙ্গে সবার দিকে তাকানো যায়, ঠোঁটে ঝুলে থাকা এক চিলতে হাসি কিভাবে শিস দেয়ার মতো দুষ্টুমির আকার পেতে পারে, শরীরের ভঙ্গি, মুখের আদল, চুলের সজ্জা কেমন হতে হবে এসব মেয়েদের কাছে ফাঁস করে না দিলে আমি বা আমরা স্বস্তিতে প্রেম করতে পারতাম। আমার প্রতিটি প্রেমে কিংবা ঊনপ্রেমে উঁকি দিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন এই লোক।

আম্মা বলতেন, আহ্, কী প্রতিভাবান আর গুণী! দেখতেও বেশ। আড়চোখে আম্মার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম তার পুত্র এমন নয় বলে তিনি বিষণ্ণ কিনা। বোনরা, কাজিন সিস্টাররা ঘোর লাগা চোখে আনিসুল হককে দেখতো টিভিতে, আর নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতো। আমার ভাল লাগতো না। আমার মনে হতো এই লোকটি না থাকলে আমিই হতাম মধ্যমণি।

তামান্না তখনও আমার বউ হয়নি। সুইডেনে বড় হওয়া মেয়েটি সদ্য দেশে এসেছে এবং আমার উড়াধুরা কবি-কবি জীবনটাকে পছন্দ করে ফেলেছে। আমাদের চেনাজানা তখন প্রেমে উত্তীর্ণ। টিভি দেখছি এক সন্ধ্যায়। আনিসুল হক হঠাৎ টিভি বক্সে। কিছুক্ষণ দেখে তামান্না বলল, লোকটিকে অন্যদের থেকে আলাদা লাগছে। ভীষণ ভীষণ অন্যরকম। কতো সাবলীল! লুকস কোয়াইট এমিনেন্ট। ভেরি ভেরি এমেজিং এ্যান্ড ব্রেথটেকিং। এমনও আছে আপনাদের এখানে? দেখলাম, আনিসুল হক মজা নিয়ে শুনছেন আর টিভিবাক্স থেকেই আমার দিকে কৌতুক চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি বিব্রত হলাম।

বিটিভিতে এই অধমের জন্যও মাসওয়ারী কিছু সময় বরাদ্দ থাকতো তখন। করিডোরে, পার্কিংয়ে, রেকর্ডিং স্টুডিয়োর সামনে বা এডিটিং রুমে আনিসুল হকের সঙ্গে একটু- আধটু দেখা হতো আর ভাবতাম, এই মানুষটি কতোবার আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন। এই অস্বস্তির কথা একদিন তাকে জানিয়েছিলাম। তিনি হেসেছিলেন। আর আমি শিখেছিলাম কিভাবে হাসতে হয়।

আনিসুল হককে শুধু আমরাই ঈর্ষা করিনি, তিনি ঈর্ষার পাত্র ছিলেন ব্যবসায়ীদের, রাজনীতিকদের। সাধারণ চাকুরে থেকে ব্যবসায়ী। তারপর শীর্ষ ব্যবসায়ী। সেখান থেকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতা। খুব সহজ নয়। এই জার্নিতে আমার মতো বহু মানুষের অস্বস্তি ছিল, অভিশাপ ছিল, অভিযোগ ছিল। তিনি হেসে হেসেই এই ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন। তারপর এলেন রাজনীতিতে। আবার অস্বস্তি। আবার ঈর্ষাপরায়ণতা। আওয়ামী লীগের পদলোভী নেতাদের পর্যুদস্ত করে তিনি ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে মনোনীত হলেন। জিতিয়েও আনা হলো তাকে। চিরদিনের জন্য শত্রু বনে গেলেন অনেকের।

আনিসুল হক এভাবেই সব মহলের ঈর্ষা, সন্দেহ আর অভিশাপ সঙ্গে নিয়ে হেঁটেছেন। আমাদের মতো নাদান প্রেমিকদের ঈর্ষা যেমন তার ঝুড়িতে, তেমনি অসাধু ব্যবসায়ী আর সুযোগসন্ধানী তথাকথিত রাজনীতিকদের ঈর্ষাও তার ঝুড়িতে। তার ব্যক্তিত্বের শানানো আলোয় আমি যেমন অস্বস্তি বোধ করতাম, ম্রিয়মাণ হয়ে যেতাম তেমনি তার ডায়নামিক মেয়রগিরির ঝলসায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল অসাধুরা। উন্নয়ন পেয়েছিল গতি।

ঈর্ষা পিছু ছাড়েনি মৃত্যুশয্যায়ও। তার রোগটির ডিজিটাল অনুবাদ করা হলো সরকার উৎখাতে ব্যর্থতাজনিত পলায়ন।

আমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর এতো অপছন্দের এতো ঈর্ষার পাত্রটি মৃত্যুর আগে যেন আমাদের সবার প্রতি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, বন্ধুগণ, আমি এই প্রথম মারা গেলাম।

ঢাকা ভুলবেনা এমনও মেয়র হয়, গতি ভুলবেনা এমনও চাকার মেধা, সততা ভুলবেনা সাহসের সংযোগ, আর মেয়েরা ভুলবেনা এমন ছেলেও হয়।

শ্রদ্ধেয় আনিস ভাই, আপনি ভাল থাকুন আপনার নতুন দেশে। আপনাকে ছাড়া আমরাও অনেক ভাল থাকবো। আমি, আমরা, বাংলাদেশ — সবাই যার যার চরিত্রে ফিরতে পারবে।

লেখক: শাকিল রিয়াজ, কবি ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

preload imagepreload image