ঢাকা শুক্রবার | ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মাসখানেক আগে ফাইবার অপটিক সাবমেরিন কেব্লের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা খানিকটা বিঘ্নিত হয়েছিল। এ সময় অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট, যেগুলো মূলত বাংলাদেশের বাইরে রাখা (হোস্ট করা), সেগুলো ব্যবহারের সময় কিছুটা ধীরগতি দেখা যায়। আবার সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-প্রক্রিয়া চলার সময় সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের সাময়িক বিঘ্নতা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল | এসব অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষাগুলোর (এসএসসি ও এইচএসসি) ফলাফল প্রকাশের দিন শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট অথবা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যাচের আগে টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইটেও এ ধরনের সমস্যা হয়েছে।
একটি ওয়েবসাইটে এ ধরনের সমস্যা কেন হতে পারে? সহজভাবে দেখতে গেলে একটি ওয়েব সার্ভারের (যেখানে ওয়েবসাইটটি রাখা হচ্ছে) নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা বা সর্বোচ্চ হিট (ওয়বসাইট দেখার সংখ্যা) নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে | পিক টাইমে ব্যবহারকারীদের হিট কাউন্ট যদি তা অতিক্রম করে, তবে সেই ওয়েবসাইটে কিছু সমস্যা (ধীরগতি, ওয়েবপেজ লোড না হওয়া বা সম্পূর্ণ ওয়েবসাইট অচল হয়ে যাওয়া) হতে পারে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরপরই কানাডার অভিবাসন ওয়েবসাইটটি অচল হয়ে যায়। কেননা, সেখানে তখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দশ গুণের বেশি ব্যবহারকারী প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট গুগল, ইউটিউব ও ফেসবুক প্রতিনিয়ত শতকোটি মানুষ ব্যবহার করছে | বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ডেটা সেন্টারগুলোর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান থাকে এই সাইটগুলো। এসব হচ্ছে মূলত ক্লাউডভিত্তিক পরিসেবা, যেখানে কোনো বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট শুধু একটি নির্দিষ্ট সার্ভার বা একটি ডেটা সেন্টারে থাকে না। বরং বিভিন্ন সার্ভার-ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে কনটেন্ট সংরক্ষিত ও সঞ্চালিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনভিত্তিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে যে ছবিটি দিচ্ছেন বা অন্য যে ছবিটি দেখছেন, সেগুলো আসতে পারে বাংলাদেশে সেই মোবাইল সংযোগদাতাকে দেওয়া প্রদত্ত ফেসবুক সার্ভার থেকে। সেই সার্ভার থাকতে পারে মুম্বাই বা সিঙ্গাপুরে। মানে যখন কোনো ছবি বা ভিডিও দেখছেন তখন যেকোনো একটা ডেটা সেন্টার থেকে ফেসবুক তা আপনাকে দেখাতে পারে। ক্লাউডভিত্তিক অনলাইন সেবার এটি হচ্ছে বড় সুবিধা |
বিষয়টি পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যাক। পণ্য যেখানে তৈরি হচ্ছে, সাধারণত সেখানেই সেটি সবচেয়ে সুলভ মূল্যে ও দ্রুত পাওয়া সম্ভব | অনলাইন কনটেন্টের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি যে ওয়েবসাইটটি দেখছেন বা যে ফাইলটি নামাচ্ছেন, তা যদি বাংলাদেশের ভেতরে থাকা কোনো ডাটাসেন্টারে থাকে, তবে তা কিছুটা হলেও দ্রুত লোড হবে।
সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, দেশের ভেতরে মানসম্পন্ন ক্লাউড হোস্টিং হতে পারে সবচেয়ে ভালো সমাধান। স্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এ ধরনের সেবা দিচ্ছে। আমাজন, গুগল, ফেসবুকের মতো যেসব প্রতিষ্ঠানের কনটেন্টের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি সেসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ ডেটা সেন্টার স্থাপনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কারণ বিশ্বজুড়ে তাদের ডেটা সেন্টারগুলো সীমিত সংখ্যায় শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্থানে তৈরি করা হয়েছে (যেমন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য মূলত সিঙ্গাপুর ও মুম্বাইয়ে এই ডেটা সেন্টারগুলোর অবস্থান)।
এ ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হচ্ছে বাজারের চাহিদা, যা বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশের ডেটা বা ইন্টারনেট কনটেন্টের চাহিদা দ্রুত বেড়ে চলছে। জিএসএমএ ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট ব্যবহারের হার, মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি কিংবা স্মার্টফোনের ব্যবহার—সব ক্ষেত্রেই শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থাকছে |
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে স্থাপিত ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী পুরো অঞ্চলের (ভুটান, নেপাল ও উত্তর-পূর্ব ভারত) চাহিদা ভালোভাবে মেটানো সম্ভব। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ডেটা কানেক্টিভিটি এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। একইভাবে ইন্টারনেট সংযোগ আমাদের একটি আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ভুটান ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ব্যান্ডউইটথ রপ্তানি করছে, খুব শিগগিরই নেপাল এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে | বর্তমানের ব্যান্ডউইটথ দিয়েই পরিবাহিত কনটেন্ট যদি বাংলাদেশেই আংশিকভাবেও হোস্ট করা যায়, তবে প্রতিবেশী এই দেশগুলোর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কিছুটা দ্রুত কনটেন্টগুলো পেতে পারেন |
দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে অধিকতর সংযুক্ত। সংক্ষেপে বলা যায়, স্থানীয় কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট শিল্পের বিকাশ ও বৈশ্বিকভাবে নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ডেটা সেন্টার এখানে স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ইন্টারনেটের আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
আযফার আদীব: টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী, আইসিটি বিশ্লেষক
বিষয়সমূহঃTags: আযফার আদীব, ইন্টারনেটের আঞ্চলিক কেন্দ্র
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ
শিরোনাম